‘তোমরা ভারতীয় টিভির
সিরিয়ালমুক্ত একটা মা দাও/আমি তোমাদের
ঝগড়ামুক্ত একটা পরিবার দেব’ এটা জনৈক
ব্যক্তির ফেসবুক স্ট্যাটাস। ভারতীয়
টিভির সিরিয়াল মানেই পারিবারিক বিরোধ,
ঝগড়া-ঝাটি, পরকীয়া, লিভ
টুগেদার, চালাকি, অপটতা, মিথ্যাবাদিতা, অশ্লীলতা,
হিন্দুত্ববাদী, শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনি, মন্দিরের
ঘণ্টা, ঢোলবাদ্য আর
অনৈতিকতা। এসব চ্যানেল সিরিয়াল মানুষের
মধ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। ‘দেখার দেখা/শেখার শেখা’ প্রবাদের
মতো আমাদের দেশে পারিবারিক বিরোধ বাড়ছে। নৈতিক অবক্ষয়, পারিবারিক
ও সামাজিক অবক্ষয় শুরু হয়ে গেছে। তিনটি ভারতীয় চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধের
দাবিতে হাইকোর্টে রিট হওয়ায় ‘কেন স্টার জলসা, স্টার প্লাস, জি বাংলা সম্প্রচার বন্ধ করা হবে না’ কারণ
দর্শানোর নোটিশ জারি করেছে আদালত বহুদিন আগে। তারপরও
বাংলাদেশের নীতি-নির্ধারকরা পারেনি বিজাতীয় সংস্কৃতির ধারক-বাহক
ভারতীয় টিভি সম্প্রচার বন্ধ করতে। কিন্তু নেপাল দেখিয়ে দিয়েছে ভারতকে
কীভাবে শিক্ষা দিতে হয়। ভারত সীমান্তে পণ্যবাহী ট্রাক আটকে রাখার কারণেই
নেপাল সব ভারতীয় চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ করে দিয়েছে। সেখানে সেøাগান উঠেছে ‘নো মোড় ভারতীয়
চ্যানেল’।ছোট্ট দেশ নেপাল পারে;
আমরা পারিনা কেন? ভারতীয়
সবকটি টেলিভিশন চ্যানেলের সম্প্রচার নিজেদের দেশে বন্ধ করে দিয়েছে নেপালের
ক্যাবল টেলিভিশন অপারেটররা। ভারত সীমান্তে জ্বালানিসহ অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বোঝাই ট্রাক আটকে রাখার প্রতিবাদে মঙ্গলবার
তারা এই সিদ্ধান্ত নেয়। হিমালয়ের পাদদেশে ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত নেপাল
প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে ভারতের ওপর নির্ভরশীল। তারপরও তারা ‘ভারতীয় টিভি আর নয়’ এমন
কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দেশ হিসেবে ভারত ধর্ম নিরপেক্ষ দাবি করলেও
মূলত হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র। ক্ষমতাসীন আর এসএসের ভাবশীর্ষ বিজেপি
এখন ক্ষমতায়। হিন্দুত্ববাদ প্রচারই তাদের নীতি। দিল্লির সরকারের মন্ত্রীদের
বক্তব্যে সেটা পরিষ্কার। কিন্তু নেপাল হিন্দুত্ববাদীতে আটকে থাকতে
চায়নি। সম্প্রতি হিন্দু রাষ্ট্রের পরিবর্তে নেপাল নিজেদের ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র ঘোষণা দিয়ে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করেছে। বিবিসির খবরে প্রকাশ ‘এরপরই নেপালের এই সংবিধানের সমালোচনায় সোচ্চার হয়ে উঠে ভারত’। নেপাল অভিযোগ করেছে
তাদের সংবিধান নিয়ে ভারত সমালোচনা করে কার্যত নেপালের অভ্যন্তরীণ
রাজনীতিতে নাক গলাচ্ছে। নেপাল সরকার ভারতের এ সমালোচনার কড়া জবাব দিয়েছে গত
সপ্তাহে। এর প্রতিক্রিয়ায়ই দুই দেশের সীমান্তে বিএসএফ নেপালগামী জ্বালানিসহ
পণ্যবাহী ট্রাক আটকে দিচ্ছে। সীমান্তে পণ্যবাহী ট্রাক আটকানোর ঘটনায়
বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে নেপালের মানুষকে। প্রতিবাদে গত মঙ্গলবার নেপালের ক্যাবল
অপারেটররা ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর সম্প্রচার নেপালে বন্ধ করে দেয়।
ভারতীয় সিনেমার প্রদর্শনীও বন্ধ করে দিয়েছে নেপালের কয়েকটি সিনেমা হল
কর্তৃপক্ষ। বিবিসির খবরে প্রকাশ নেপাল ক্যাবল টিভি অপারেটর্স
অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান
সুধীর পরাজুলি জানিয়েছেন, ‘তারা
মনে করেন নেপালের সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ করছে ভারত’। এ জন্য তারা ৪২টি
ভারতীয় স্যাটেলাইট চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ করে দিয়েছে। অবশ্য
ভারত এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তাদের দাবি নিরাপত্তার কারণে সীমান্তে ট্রাক
আটকানো হয়েছে।সম্প্রতি ভারতের সেনাবাহিনী সেভেন সিস্টার্স এ
বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধের সময় মায়ানমার সীমান্ত অতিক্রম করে। এ খবর প্রচার হওয়ায় তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে
মায়ানমার সরকার। অথচ হরহামেশাই সীমান্ত অতিক্রম করে
ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা (বিএসএফ)
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করছে এবং
আমাদের লোকজনকে হত্যা করছে। সীমান্তে
বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশি হত্যা কার্যত
নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়ে
গেছে। তারপরও আমরা কোনো শব্দ করছি না।
শুধু তাই নয় নেপালের সংবিধান ইস্যুতে
ভারতের প্রতিক্রিয়া সে দেশের সরকার ও
সাধারণ মানুষ ‘অভ্যন্তরীণ রাজনীতির
হস্তক্ষেপের সামিল’ মনে
করে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে এবং ভারতীয় ৪২টি চ্যানেল সম্প্রচার
বন্ধ করে দিয়েছে। আর আমরা? বাংলাদেশের রাজনীতি যেন নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে
দিল্লির সাউথ ব্লক থেকেই। ক্ষমতা ধরে রাখতে এবং ক্ষমতায় যেতে আমাদের
নেতানেত্রীরা যেন দিল্লিকে তোয়াজের প্রতিযোগিতা করেন। দিল্লির শাসকদের অনুকম্পা পেতে আমরা কতই না কসরত করছি! বড় দলগুলোর
নেতা-নেত্রীদের আচরণ এবং কথাবার্তা এমন যে ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর
দিল্লির আশীর্বাদ অপরিহার্য। দেশের জনগণের ভোট নয়, বরং
ক্ষমতায় কোন দল যাবে বা
থাকবে তা নির্ধারণ করে দেয় দিল্লির সাউথ
ব্লক।’ অবশ্য ২০১৪ সালের ৫
জানুয়ারির নির্বাচনে তেমনটিই ঘটেছে বলে
মনে করেন দেশের বুদ্ধিজীবী ও ভোটের
অধিকার হারানো সাধারণ মানুষ। বিতর্কিত
ওই নির্বাচনের আগে ভারতের পররাষ্ট্র
সচিব সুজাতা সিং ঢাকা সফরে এসে জাতীয়
পার্টির চেয়ারম্যান এইচএম এরশাদকে
পরামর্শ দেন ‘আওয়ামী লীগ যেভাবে
চায় সেভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে নির্বাচন করার’। তিনি বিভিন্ন দলের
নেতার সঙ্গে বৈঠক করে দিল্লির বার্তা পৌঁছে দেন। পরবর্তীতে সাবেক
প্রেসিডেন্ট এরশাদ এই তথ্য ফাঁস করে দেয়ায় মিডিয়ায় তোলপাড় হয়। বাংলাদেশে
রাজনীতির নামে যে অপরাজনীতি চলছে; নীতি নৈতিকতার বদলে যে অনৈতিকতার চর্চাই বেশি হচ্ছে সেটা ওপেন সিক্রেট। ভারতের
ক্ষমতাসীন দলের সভাপতি অমিতশাকে ফোন করার ‘সত্যমিথ্যা’ নিয়ে
আওয়ামী লীগ আর বিএনপির নেতাদের
মধ্যে যে বাহাস হয়েছে তাতে জনগণের কাছে
দুই দলের অবস্থান পরিষ্কার হয়ে
যায়। নেতা-নেত্রীদের পরমুখাপেক্ষীতার
কারণে ভারতের ওপর নির্ভরশীল হয়েও
নেপাল যা পারছে, আমরা
তা পারছি না কেন? আমাদের কি দেশপ্রেম,
নীতি নৈতিকতা, সাহসের
বড়ই অভাব? নাকি আমরা অপরের গলগ্রহ হয়ে তাঁবেদারের মতো বেঁচে থাকতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছি?
দেশের সকলেই একবাক্যে স্বীকার করছেন
ভারতীয় চ্যানেলের বিরূপ প্রভাব পড়ছে আমাদের সমাজে। ওই সব চ্যানেল
সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে দিচ্ছে অনৈতিকতা। বিজ্ঞাপন, সংগীত
শিক্ষালয়, নাট্যবিদ্যালয়,
নাট্যশালা, আর্টস
স্কুল, ফ্যাশন-শো, সংগীত-অভিনয়-সুন্দরী প্রতিযোগিতা, পাঠ্যপুস্তক, সাহিত্য, সেমিনার, এনজিও, হাসপাতাল, রূপচর্চা
কেন্দ্র, শিক্ষাবৃত্তি, ক্লাব-সমিতি, সাংস্কৃতিক
সফর, চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে। পাশাপাশি তাদের
টিভি চ্যানেলগুলোতে নিত্যদিন প্রচারিত গল্পবিহীন সিরিয়ালে কপটতা, অনৈতিকতা, পারিবারিক
কলহ, কুটিলতা, শিশুদের মিথ্যা বলা, ছলাকলা, চাতুরি
শেখানোর কৌশলে ভরপুর। অশ্লীলতা ছাড়াও পারিবারিক কলহ,
ভাইয়ে ভাইয়ে বিরোধ, মা-ছেলে
বিরোধ, বউ-শাশুড়ির ঝগড়া,
বউ-ঝি’র হিংসা-বিদ্বেষ শেখানো-দেখানো নিত্যদিন। অভিনেত্রীদের মেকাপ-গেটআপে
অর্ধনগ্ন-অশ্লীলতায় ভরপুর এসব সিরিয়ালের মাধ্যমে হিন্দুদের
ধর্মীয় সাংস্কৃতি আমাদের সমাজে
ছড়িয়ে দিচ্ছে। ভারতীয় চ্যানেলে নিত্য
প্রচারিত শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনি, মন্দিরের ঘণ্টা, ঢোলবাদ্য
‘হিন্দু রাষ্ট্র’
হিসেবে পরিচিত নেপালের মানুষ পছন্দ করছে না। যার কারণে তারা ভারতীয় ৪২টিভি চ্যানেলের
সম্প্রদার বন্ধ করে দিয়েছে। অথচ আমরা সে সাহস দেখাতে পারছি
না? জাতি হিসেবে নেপাল কি আমাদের চেয়ে বেশি উন্নত? সুচকের
প্রতিটি ক্ষেত্রে নেপাল আমাদের (বাংলাদেশ) নিচে। তারপরও ছোট্ট দেশ
নেপাল যা পারে আমরা তা কেন পারছি না কেন?
-