বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করার ফলে কারা লাভবান
হয়েছেন, তা নিয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম নায়ক জেনারেল
জিয়াউর রহমান ও দক্ষিণপন্থী দলগুলোর দিকে আঙুল নির্দেশ করা হলেও অনেকের
ধারণা, বঙ্গবন্ধু হত্যার অন্যতম প্রধান বেনিফিশিয়ারি হচ্ছেন জেনারেল হুসেইন
মুহম্মদ এরশাদ।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার কারণেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ না নিয়েও এইচ এম এরশাদ ১৫ আগস্ট-পরবর্তী খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ নিযুক্ত হন এবং পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে চিফ অব স্টাফ পদে প্রমোশন পান। বঙ্গবন্ধু যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে এরশাদের পক্ষে কখনোই সেনাপ্রধান হওয়া সম্ভব ছিল না। কারণ, বঙ্গবন্ধু একজন অমুক্তিযোদ্ধাকে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর চাপিয়ে দিতেন না। মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী (অব:) বীরবিক্রমের লেখা ‘এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য : স্বাধীনতার প্রথম দশক’ বইয়ে উল্লিখিত একটি ঘটনা থেকে এর প্রমাণও পাওয়া যায়। জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী লিখেছেন, ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে পাকিস্তানফেরত সিনিয়র আর্মি অফিসার ছিলেন লে. জেনারেল খাজা ওয়াসিউদ্দিন ও মেজর জেনারেল এম আই করিম। পাকিস্তান আর্মিকে সহযোগিতা করার জন্য মেজর জেনারেল এম আই করিমকে চাকরি থেকে অবসর দেয়া হয়। পাকিস্তান থেকে ফেরত আসার দিন লে. জেনারেল ওয়াসিউদ্দিনকে বিমানবন্দরে জেনারেল ওসমানী অভ্যর্থনা জানান। ওসমানী উদ্যোগী হয়ে তাকে মন্ত্রী ও অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ করান। ফলে সেনানিবাসে জোর গুজব ছড়িয়ে পড়ে, মেজর জেনারেল শফিউল্লাহর স্থলে লে. জেনারেল ওয়াসিউদ্দিনকে সেনাপ্রধান করা হবে। মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করেন এ সম্পর্কে আমি কিছু জানি কি না। উত্তরে আমি এ সম্পর্কে কিছুই জানি না বলে জানাই। তিনি আমাকে এ সম্পর্কে খোঁজ নেয়ার জন্য বলেন। আমি টেলিফোনে সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির বাসভবনে ওই রাতেই দেখা করি। আমি তাঁকে জানাই যে, আর্মিতে জোর গুজব, জেনারেল ওয়াসিউদ্দিনকে সেনাপ্রধান করা হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি জানতে চান, আমি কোথা থেকে এ খবর পেলাম। একটু থেমে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একজন পরীক্ষিত খাঁটি দেশপ্রেমিক বাঙালিই কেবল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সেনাপ্রধান হওয়ার যোগ্যতা রাখে। এরপর আমি সেনানিবাসে চলে আসি এবং মেজর জেনারেল শফিউল্লাহকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমার আলোচনার বিষয়ে অবহিত ও আশ্বস্ত করি।’ (পৃষ্ঠা-৫৭ ও ৫৮)।
জেনারেল এরশাদ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেননি এটা সবাই জানেন। কিন্তু কেন দেননি বা দিতে পারেননি তা স্পষ্ট নয়। ১৫ আগস্ট-পরবর্তী সরকারের নিযুক্ত চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ মেজর জেনারেল খলিলুর রহমানের ভাষ্য মতে, সিন্ধু প্রদেশের মালি সেনানিবাসে অবস্থিত সপ্তম বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক লে. কর্নেল এরশাদ তার মতোই মুক্তিযুদ্ধে যেতে আগ্রহী ছিলেন, কিন্তু করাচি থেকে ৫০০ মাইলের মতো পথ এক রাতে অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করা অসম্ভব ছিল না বলে তারা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে পারেননি। নিচে জেনারেল খলিলের ভাষ্যটি হুবহু উল্লেখ করা হলোÑ “যথাসময় উপস্থিত হলাম করাচিতে। ঐদিন সন্ধ্যায় গেলাম মালির সেনানিবাসে সপ্তম বেঙ্গল সদর দফতরে, লে. কর্নেল এরশাদের (পরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি) বাসায়। আমরা অতি ঘনিষ্ঠ বলে পরস্পরের চিন্তাধারাও জানতাম। অতএব, সময়ক্ষেপণ না করে আলোচনা শুরু হলো। আমি, এরশাদ ও এরশাদের স্ত্রী তিনজনে আলোচনা করছি কিভাবে সীমান্ত পার হয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়া যায়। ম্যাপ খুলে বসলামÑ এরশাদের সপ্তম বেঙ্গলের দায়িত্বপ্রাপ্ত সীমান্ত এবং করাচি থেকে সেখানে জিপে করে যাওয়ার রাস্তা ও পথের দূরত্ব সব কিছু আলোচনায় এলো; কিন্তু সন্তোষজনক কোনো ফলাফল বেরুলো না। করাচি থেকে সীমান্তের দূরত্ব, যে দিক দিয়ে গণনা করা যাক না কেন, পাঁচ শ’ মাইলের কম নয়। রাস্তার বেশির ভাগ অংশই পাকা নয়। এই রাস্তায় সারা রাত বিরামহীনভাবে গাড়ি চালালেও সকালের আগে গন্তব্যে পৌঁছা সম্ভব নয়। অথচ আমাদের সীমান্ত অতিক্রম এক রাতের মধ্যে করতেই হবে। কারণ পরদিন সাতসকালে সবাই জানতে পারবে যে, আমরা পালিয়েছি। অতএব, অত্যন্ত ভগ্নহৃদয়ে রাতের খাওয়া সেরে বিদায় নিলাম এরশাদ দম্পতির বাসা থেকে। পরদিন ফিরে এলাম রাওয়ালপিন্ডিতে।” (পৃষ্ঠা-২৮)।
১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বরে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সংঘটিত সেনা অভ্যুত্থানের অন্যতম নায়ক কর্নেল শাফায়াত জামিলের (অব:) মতে, এরশাদ ইচ্ছে করেই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেননি। ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর’ শীর্ষক বইয়ে কর্নেল শাফায়াত জামিল লিখেছেন, ‘এরশাদ সম্পর্কে বলার আরো রয়েছে। অভিযোগ শোনা যায়, মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি একাধিকবার বাংলাদেশে আসেন এবং যুদ্ধে যোগ দেয়ার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তানে ফিরে যান।’ (পৃষ্ঠা-১১৭)।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ এইচ এম এরশাদ কোথায় ছিলেন তা নিয়েও সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন জিওসি মেজর জেনারেল (অব:) খাদিম হোসেইন রাজার দেয়া একটি তথ্যের কারণে। জেনারেল রাজা তার লেখা "A stranger in my own country" বইয়ে লিখেছেন, “(বাংলা অনুবাদ) সৈয়দপুরের একটি অস্থায়ী শিবিরে দু’টি ব্যাটালিয়ন ছিল। ফ্রন্টিয়ার ফোর্স ব্যাটালিয়নের কমান্ডার ছিলেন লে. কর্নেল হাকিম আরশাদ কোরেশী (পরবর্তীকালে মেজর জেনারেল) এবং তৃতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক ছিলেন লে. কর্নেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ (পরবর্তীকালে লে. জেনারেল ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি)। সংক্ষিপ্ত গুলিবিনিময়ের পর বাঙ্গালী ব্যাটালিয়নটি অস্ত্রসহ ক্যাম্প ছেড়ে চলে যায় এবং এরপর আর কোনো প্রতিরোধ গড়ে তোলেনি।” (পৃষ্ঠা-৮৪)। যেহেতু ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরিচালিত অপারেশন সার্চ লাইটের অধিনায়ক ছিলেন জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা, সে কারণে কোন বাহিনীর অধিনায়ক কে ছিল সে সম্পর্কিত সব তথ্য তার কাছে থাকাই স্বাভাবিক।
জেনারেল এরশাদ রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধাদের এ দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান ঘোষণা করলেও সেনাবাহিনীতে চাকরি করার সময় তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের দুই বছরের সিনিয়রিটি দেয়ার তীব্র বিরোধী ছিলেন। শাফায়াত জামিল লিখেছেন, ‘এরশাদ বাংলাদেশে আগমনের পর আর্মি হেডকোয়ার্টারের প্রথম কনফারেন্সে মুক্তিযোদ্ধাদের দুই বছরের সিনিয়রিটিকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন।’ (একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর, পৃষ্ঠা-১১৫)।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সংঘটিত সেনা-অভ্যুত্থানের পর ২৪ আগস্ট মেজর জেনারেল শফিউল্লাহকে সরিয়ে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে নতুন চিফ অব স্টাফ এবং ভারতে প্রশিক্ষণ গ্রহণরত ব্রিগেডিয়ার এইচ এম এরশাদকে প্রমোশন দিয়ে ডেপুটি চিফ অব স্টাফ নিয়োগ করা হয়। ভারতে প্রশিক্ষণে থাকা অবস্থায় কয়েক মাসের মধ্যে এরশাদ কর্নেল থেকে দুটো প্রমোশন পেয়ে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন, যা কিনা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইতিহাসে একটি বিরল ঘটনা। জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরীর দেয়া তথ্য থেকে জানা যায়, লেফটেন্যান্ট থেকে মেজর পদে উন্নীত হতে এরশাদের লেগেছিল ১৩ বছর।
এখন প্রশ্ন হলো, নিজেরা মুক্তিযোদ্ধা হওয়া সত্ত্বেও রশিদ-ফারুক-ডালিমরা কেন উপ-সেনাপ্রধান হিসেবে পাকিস্তান-ফেরত এরশাদকে বেছে নিলেন? এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় শাফায়াত জামিলের বইয়ে। তিনি লিখেছেনÑ “নিতান্ত স্বল্প সময়ের মধ্যে দেশের বাইরে অবস্থানরত এরশাদের এই দু’দুটো বিধিবহির্ভূত পদোন্নতি এবং উপপ্রধানের পদ লাভের সঙ্গে ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের কোনো যোগসূত্র আছে কি না, সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। স্মর্তব্য, মেজর ডালিম ও গাজী গোলাম মোস্তাফার বিরোধে এরশাদ ডালিমের পক্ষে শৃঙ্খলাবিরোধী জোরালো ভূমিকা রেখেছিলেন। এ ছাড়া মেজর রশিদ ও ব্রিগেডিয়ার এরশাদ উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য প্রায় একই সময় দিল্লিতে অস্থান করছিলেন। এসবের মধ্যে কোনো যোগসূত্র থাকাটা তাই অসম্ভব কিছু নয়।” (পৃষ্ঠা-১২০)।
মেজর ডালিম ও গাজী গোলাম মোস্তাফার বিরোধ প্রসঙ্গে শাফায়াত জামিল লেখেনÑ “ ’৭৪ সালের শেষ দিকের কথা। মেজর ডালিমের সঙ্গে প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা গাজী গোলাম মোস্তাফার একটি পারিবারিক দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে ঘটনার পরদিন তদানীন্তন কর্নেল এরশাদ ঘোলাপানিতে মাছ শিকারের মতলব আঁটেন। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তিনি একদল তরুণ অফিসারকে নেতৃত্ব দিয়ে তৎকালীন সেনা উপপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়ার অফিসে যান এবং ঐ ঘটনায় সেনাবাহিনীর সরাসরি হস্তক্ষেপের দাবি করেন। অথচ কর্নেল এরশাদ তখন এজি (অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল), অর্থাৎ সেনাবাহিনীর সার্বিক শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত। আমি এ ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শী। সেনা উপপ্রধান তাৎক্ষণিকভাবে কর্নেল এরশাদের ঐ অযৌক্তিক দাবি প্রত্যাখ্যান করে তাঁর দায়িত্ববোধ সম্পর্কে সতর্ক করে দেন। বিদ্রোহতুল্য এই আচরণের জন্য জিয়া কর্নেল এরশাদকে তীব্র ভাষায় তিরস্কার করে বলেন, তার এই অপরাধ কোর্ট মার্শাল হওয়ার যোগ্য। এ ঘটনার জন্য ঐদিনই বিকেলে বঙ্গবন্ধু তাঁর অফিসে সেনাপ্রধান, উপপ্রধান, কর্নেল এরশাদ এবং আমাকে তলব করেন। এরশাদের আচরণের জন্য উপস্থিত সবাইকে কঠোর ভাষায় ভর্ৎসনা করেন তিনি। এর পরও সাবেক সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ কর্নেল এরশাদের বিরুদ্ধে কোনো শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ তো করলেনই না, বরং তাঁর প্রিয়ভাজন এই কর্নেলকে কয়েক দিন পরই দিল্লিতে পাঠিয়ে দিলেন উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য। অল্প কয়েক দিন পরই নিয়মবহির্ভূতভাবে Supernumery Establishment-এ থাকা অবস্থায় তার পদোন্নতিরও ব্যবস্থা করেন। কর্নেল থেকে ব্রিগেডিয়ার হয়ে গেলেন এরশাদ।” (পৃষ্ঠা-১১৬)।
তিনি আরো লেখেনÑ “পনেরো আগস্টের অভ্যুত্থানকারীদের সঙ্গে এরশাদের ঘনিষ্ঠতা ও তাদের প্রতি তার সহমর্মিতা লক্ষণীয়। পরবর্তী সময়ের দুটো ঘটনা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রথমটি, খুব সম্ভবত মেজর জেনারেল জিয়ার সেনাপ্রধানের দায়িত্ব নেয়ার পরবর্তী দ্বিতীয় দিনের ঘটনা। আমি সেনাপ্রধানের অফিসে তাঁর উল্টো দিকে বসে আছি। হঠাৎ করেই রুমে ঢুকলেন সদ্য পদোন্নতিপ্রাপ্ত ডেপুটি চিফ মেজর জেনারেল এরশাদ। এরশাদের তখন প্রশিক্ষণের জন্য দিল্লিতে থাকার কথা। তাকে দেখামাত্রই সেনাপ্রধান জিয়া বেশ রূঢ়ভাবে জিজ্ঞেস করলেন, তিনি বিনা অনুমতিতে কেন দেশে ফিরে এসেছেন। জবাবে এরশাদ বললেন, তিনি দিল্লিতে অবস্থানরত তার স্ত্রীর জন্য একজন গৃহভৃত্য নিতে এসেছেন। এই জবাব শুনে জিয়া অত্যন্ত রেগে গিয়ে বললেন, আপনার মতো সিনিয়র অফিসারদের এই ধরনের লাগামছাড়া আচরণের জন্যই জুনিয়র অফিসাররা রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যা করে দেশের ক্ষমতা দখলের মতো কাজ করতে পেরেছে। জিয়া তাঁর ডেপুটি এরশাদকে পরবর্তী ফাইটেই দিল্লি ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। তাকে বঙ্গভবনে যেতেও নিষেধ করলেন। এরশাদকে বসার কোনো সুযোগ না দিয়ে জিয়া তাকে একরকম তাড়িয়েই দিলেন। পরদিন ভোরে এরশাদ তার প্রশিক্ষণস্থলে চলে গেলেন ঠিকই, কিন্তু সেনাপ্রধান জিয়ার নির্দেশ অমান্য করে রাতে তিনি বঙ্গভবনে যান। অনেক রাত পর্যন্ত তিনি সেখানে অস্থানরত অভ্যুত্থানকারীদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এর থেকেই মনে হয় এরশাদ আসলে তাদের সঙ্গে সলাপরামর্শ করার জন্যই ঢাকায় এসেছিলেন।
দ্বিতীয় ঘটনাটি আরো পরের। জিয়ার শাসনামলের শেষদিকের কথা। ঐ সময় বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের বিভিন্ন দূতাবাসে কর্মরত ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকারী অফিসাররা গোপনে মিলিত হয়ে জিয়া সরকারকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্র করে। এ পর্যায়ে ওই ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে গেলে তাদের সবাইকে ঢাকায় তলব করা হয়। সম্ভাব্য বিপদ আঁচ করতে পেরে চক্রান্তকারী অফিসাররা যার যার দূতাবাস ত্যাগ করে লন্ডনসহ বিভিন্ন জায়গায় রাজনৈতিক আশ্রয় নেয়। এ দিকে বাংলাদেশে সেনাবাহিনীতে কর্মরত কয়েকজন সদস্য একই অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে বিচারের সম্মুখীন হন। ...পরবর্তীকালে, জেনারেল এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার পর অভ্যুত্থানকারীদের মধ্যে যারা চাকরি করতে চেয়েছিলেন, এরশাদ তাদেরকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চাকরিতে পুনর্বহাল করেন। দ্বিতীয়বারের মতো পুনর্বাসিত হলো ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকারীরা। পোস্টিং নিয়ে তাদের অনেকে বিভিন্ন দূতাবাসে যোগ দেয়। শুধু পুনর্বাসনই নয়, এরশাদ আগস্ট অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত উল্লিখিত অফিসারদের কর্মস্থলে বিনানুমতিতে অনুপস্থিতকালের প্রায় তিন বছরের পুরো বেতন ও ভাতার ব্যবস্থাও করে দেন। ...প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়, অভ্যুত্থানকারীদের প্রতি কী দায়বদ্ধতা ছিল প্রেসিডেন্ট এরশাদের যে, কর্মস্থল ছেড়ে তিন বছর আইনের হাত থেকে পালিয়ে থাকার পরও ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকারীদের বিচার অনুষ্ঠান এড়িয়ে গিয়ে তাদেরকে আবার চাকরিতে পুনর্বহাল করলেন তিনি? ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রত্যক্ষভাবে উপকৃত হওয়াতেই অভ্যুত্থানকারীদের ঋণ শোধ করতে এরশাদ এ কাজ করেছিলেন কি না, এ প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। ঘটনাপ্রবাহ থেকে এ কথা মনে করা মোটেই অযৌক্তিক নয় যে, ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থান ও হত্যাকাণ্ডের পেছনে এরশাদের একটি পরোক্ষ কিন্তু জোরালো ভূমিকা ছিল।” (পৃষ্ঠা-১২০ ও ১২১)।
এ ছাড়া পরবর্তীকালেও দেখা যায়, জেনারেল এরশাদ ১৯৮৮ সালের চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফারুক-রশিদের নেতৃত্বাধীন ফ্রিডম পার্টিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দিয়েছিলেন এবং রশিদকে সংসদ সদস্যও বানিয়েছিলেন
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার কারণেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ না নিয়েও এইচ এম এরশাদ ১৫ আগস্ট-পরবর্তী খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ নিযুক্ত হন এবং পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে চিফ অব স্টাফ পদে প্রমোশন পান। বঙ্গবন্ধু যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে এরশাদের পক্ষে কখনোই সেনাপ্রধান হওয়া সম্ভব ছিল না। কারণ, বঙ্গবন্ধু একজন অমুক্তিযোদ্ধাকে মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর চাপিয়ে দিতেন না। মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী (অব:) বীরবিক্রমের লেখা ‘এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য : স্বাধীনতার প্রথম দশক’ বইয়ে উল্লিখিত একটি ঘটনা থেকে এর প্রমাণও পাওয়া যায়। জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী লিখেছেন, ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে পাকিস্তানফেরত সিনিয়র আর্মি অফিসার ছিলেন লে. জেনারেল খাজা ওয়াসিউদ্দিন ও মেজর জেনারেল এম আই করিম। পাকিস্তান আর্মিকে সহযোগিতা করার জন্য মেজর জেনারেল এম আই করিমকে চাকরি থেকে অবসর দেয়া হয়। পাকিস্তান থেকে ফেরত আসার দিন লে. জেনারেল ওয়াসিউদ্দিনকে বিমানবন্দরে জেনারেল ওসমানী অভ্যর্থনা জানান। ওসমানী উদ্যোগী হয়ে তাকে মন্ত্রী ও অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ করান। ফলে সেনানিবাসে জোর গুজব ছড়িয়ে পড়ে, মেজর জেনারেল শফিউল্লাহর স্থলে লে. জেনারেল ওয়াসিউদ্দিনকে সেনাপ্রধান করা হবে। মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করেন এ সম্পর্কে আমি কিছু জানি কি না। উত্তরে আমি এ সম্পর্কে কিছুই জানি না বলে জানাই। তিনি আমাকে এ সম্পর্কে খোঁজ নেয়ার জন্য বলেন। আমি টেলিফোনে সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির বাসভবনে ওই রাতেই দেখা করি। আমি তাঁকে জানাই যে, আর্মিতে জোর গুজব, জেনারেল ওয়াসিউদ্দিনকে সেনাপ্রধান করা হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি জানতে চান, আমি কোথা থেকে এ খবর পেলাম। একটু থেমে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একজন পরীক্ষিত খাঁটি দেশপ্রেমিক বাঙালিই কেবল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সেনাপ্রধান হওয়ার যোগ্যতা রাখে। এরপর আমি সেনানিবাসে চলে আসি এবং মেজর জেনারেল শফিউল্লাহকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আমার আলোচনার বিষয়ে অবহিত ও আশ্বস্ত করি।’ (পৃষ্ঠা-৫৭ ও ৫৮)।
জেনারেল এরশাদ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেননি এটা সবাই জানেন। কিন্তু কেন দেননি বা দিতে পারেননি তা স্পষ্ট নয়। ১৫ আগস্ট-পরবর্তী সরকারের নিযুক্ত চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ মেজর জেনারেল খলিলুর রহমানের ভাষ্য মতে, সিন্ধু প্রদেশের মালি সেনানিবাসে অবস্থিত সপ্তম বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক লে. কর্নেল এরশাদ তার মতোই মুক্তিযুদ্ধে যেতে আগ্রহী ছিলেন, কিন্তু করাচি থেকে ৫০০ মাইলের মতো পথ এক রাতে অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করা অসম্ভব ছিল না বলে তারা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে পারেননি। নিচে জেনারেল খলিলের ভাষ্যটি হুবহু উল্লেখ করা হলোÑ “যথাসময় উপস্থিত হলাম করাচিতে। ঐদিন সন্ধ্যায় গেলাম মালির সেনানিবাসে সপ্তম বেঙ্গল সদর দফতরে, লে. কর্নেল এরশাদের (পরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি) বাসায়। আমরা অতি ঘনিষ্ঠ বলে পরস্পরের চিন্তাধারাও জানতাম। অতএব, সময়ক্ষেপণ না করে আলোচনা শুরু হলো। আমি, এরশাদ ও এরশাদের স্ত্রী তিনজনে আলোচনা করছি কিভাবে সীমান্ত পার হয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়া যায়। ম্যাপ খুলে বসলামÑ এরশাদের সপ্তম বেঙ্গলের দায়িত্বপ্রাপ্ত সীমান্ত এবং করাচি থেকে সেখানে জিপে করে যাওয়ার রাস্তা ও পথের দূরত্ব সব কিছু আলোচনায় এলো; কিন্তু সন্তোষজনক কোনো ফলাফল বেরুলো না। করাচি থেকে সীমান্তের দূরত্ব, যে দিক দিয়ে গণনা করা যাক না কেন, পাঁচ শ’ মাইলের কম নয়। রাস্তার বেশির ভাগ অংশই পাকা নয়। এই রাস্তায় সারা রাত বিরামহীনভাবে গাড়ি চালালেও সকালের আগে গন্তব্যে পৌঁছা সম্ভব নয়। অথচ আমাদের সীমান্ত অতিক্রম এক রাতের মধ্যে করতেই হবে। কারণ পরদিন সাতসকালে সবাই জানতে পারবে যে, আমরা পালিয়েছি। অতএব, অত্যন্ত ভগ্নহৃদয়ে রাতের খাওয়া সেরে বিদায় নিলাম এরশাদ দম্পতির বাসা থেকে। পরদিন ফিরে এলাম রাওয়ালপিন্ডিতে।” (পৃষ্ঠা-২৮)।
১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বরে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে সংঘটিত সেনা অভ্যুত্থানের অন্যতম নায়ক কর্নেল শাফায়াত জামিলের (অব:) মতে, এরশাদ ইচ্ছে করেই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেননি। ‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর’ শীর্ষক বইয়ে কর্নেল শাফায়াত জামিল লিখেছেন, ‘এরশাদ সম্পর্কে বলার আরো রয়েছে। অভিযোগ শোনা যায়, মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি একাধিকবার বাংলাদেশে আসেন এবং যুদ্ধে যোগ দেয়ার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তানে ফিরে যান।’ (পৃষ্ঠা-১১৭)।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ এইচ এম এরশাদ কোথায় ছিলেন তা নিয়েও সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন জিওসি মেজর জেনারেল (অব:) খাদিম হোসেইন রাজার দেয়া একটি তথ্যের কারণে। জেনারেল রাজা তার লেখা "A stranger in my own country" বইয়ে লিখেছেন, “(বাংলা অনুবাদ) সৈয়দপুরের একটি অস্থায়ী শিবিরে দু’টি ব্যাটালিয়ন ছিল। ফ্রন্টিয়ার ফোর্স ব্যাটালিয়নের কমান্ডার ছিলেন লে. কর্নেল হাকিম আরশাদ কোরেশী (পরবর্তীকালে মেজর জেনারেল) এবং তৃতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক ছিলেন লে. কর্নেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ (পরবর্তীকালে লে. জেনারেল ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি)। সংক্ষিপ্ত গুলিবিনিময়ের পর বাঙ্গালী ব্যাটালিয়নটি অস্ত্রসহ ক্যাম্প ছেড়ে চলে যায় এবং এরপর আর কোনো প্রতিরোধ গড়ে তোলেনি।” (পৃষ্ঠা-৮৪)। যেহেতু ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরিচালিত অপারেশন সার্চ লাইটের অধিনায়ক ছিলেন জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা, সে কারণে কোন বাহিনীর অধিনায়ক কে ছিল সে সম্পর্কিত সব তথ্য তার কাছে থাকাই স্বাভাবিক।
জেনারেল এরশাদ রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধাদের এ দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান ঘোষণা করলেও সেনাবাহিনীতে চাকরি করার সময় তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের দুই বছরের সিনিয়রিটি দেয়ার তীব্র বিরোধী ছিলেন। শাফায়াত জামিল লিখেছেন, ‘এরশাদ বাংলাদেশে আগমনের পর আর্মি হেডকোয়ার্টারের প্রথম কনফারেন্সে মুক্তিযোদ্ধাদের দুই বছরের সিনিয়রিটিকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন।’ (একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর, পৃষ্ঠা-১১৫)।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সংঘটিত সেনা-অভ্যুত্থানের পর ২৪ আগস্ট মেজর জেনারেল শফিউল্লাহকে সরিয়ে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে নতুন চিফ অব স্টাফ এবং ভারতে প্রশিক্ষণ গ্রহণরত ব্রিগেডিয়ার এইচ এম এরশাদকে প্রমোশন দিয়ে ডেপুটি চিফ অব স্টাফ নিয়োগ করা হয়। ভারতে প্রশিক্ষণে থাকা অবস্থায় কয়েক মাসের মধ্যে এরশাদ কর্নেল থেকে দুটো প্রমোশন পেয়ে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন, যা কিনা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইতিহাসে একটি বিরল ঘটনা। জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরীর দেয়া তথ্য থেকে জানা যায়, লেফটেন্যান্ট থেকে মেজর পদে উন্নীত হতে এরশাদের লেগেছিল ১৩ বছর।
এখন প্রশ্ন হলো, নিজেরা মুক্তিযোদ্ধা হওয়া সত্ত্বেও রশিদ-ফারুক-ডালিমরা কেন উপ-সেনাপ্রধান হিসেবে পাকিস্তান-ফেরত এরশাদকে বেছে নিলেন? এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় শাফায়াত জামিলের বইয়ে। তিনি লিখেছেনÑ “নিতান্ত স্বল্প সময়ের মধ্যে দেশের বাইরে অবস্থানরত এরশাদের এই দু’দুটো বিধিবহির্ভূত পদোন্নতি এবং উপপ্রধানের পদ লাভের সঙ্গে ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের কোনো যোগসূত্র আছে কি না, সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। স্মর্তব্য, মেজর ডালিম ও গাজী গোলাম মোস্তাফার বিরোধে এরশাদ ডালিমের পক্ষে শৃঙ্খলাবিরোধী জোরালো ভূমিকা রেখেছিলেন। এ ছাড়া মেজর রশিদ ও ব্রিগেডিয়ার এরশাদ উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য প্রায় একই সময় দিল্লিতে অস্থান করছিলেন। এসবের মধ্যে কোনো যোগসূত্র থাকাটা তাই অসম্ভব কিছু নয়।” (পৃষ্ঠা-১২০)।
মেজর ডালিম ও গাজী গোলাম মোস্তাফার বিরোধ প্রসঙ্গে শাফায়াত জামিল লেখেনÑ “ ’৭৪ সালের শেষ দিকের কথা। মেজর ডালিমের সঙ্গে প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা গাজী গোলাম মোস্তাফার একটি পারিবারিক দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে ঘটনার পরদিন তদানীন্তন কর্নেল এরশাদ ঘোলাপানিতে মাছ শিকারের মতলব আঁটেন। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তিনি একদল তরুণ অফিসারকে নেতৃত্ব দিয়ে তৎকালীন সেনা উপপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়ার অফিসে যান এবং ঐ ঘটনায় সেনাবাহিনীর সরাসরি হস্তক্ষেপের দাবি করেন। অথচ কর্নেল এরশাদ তখন এজি (অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল), অর্থাৎ সেনাবাহিনীর সার্বিক শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত। আমি এ ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শী। সেনা উপপ্রধান তাৎক্ষণিকভাবে কর্নেল এরশাদের ঐ অযৌক্তিক দাবি প্রত্যাখ্যান করে তাঁর দায়িত্ববোধ সম্পর্কে সতর্ক করে দেন। বিদ্রোহতুল্য এই আচরণের জন্য জিয়া কর্নেল এরশাদকে তীব্র ভাষায় তিরস্কার করে বলেন, তার এই অপরাধ কোর্ট মার্শাল হওয়ার যোগ্য। এ ঘটনার জন্য ঐদিনই বিকেলে বঙ্গবন্ধু তাঁর অফিসে সেনাপ্রধান, উপপ্রধান, কর্নেল এরশাদ এবং আমাকে তলব করেন। এরশাদের আচরণের জন্য উপস্থিত সবাইকে কঠোর ভাষায় ভর্ৎসনা করেন তিনি। এর পরও সাবেক সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ কর্নেল এরশাদের বিরুদ্ধে কোনো শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ তো করলেনই না, বরং তাঁর প্রিয়ভাজন এই কর্নেলকে কয়েক দিন পরই দিল্লিতে পাঠিয়ে দিলেন উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য। অল্প কয়েক দিন পরই নিয়মবহির্ভূতভাবে Supernumery Establishment-এ থাকা অবস্থায় তার পদোন্নতিরও ব্যবস্থা করেন। কর্নেল থেকে ব্রিগেডিয়ার হয়ে গেলেন এরশাদ।” (পৃষ্ঠা-১১৬)।
তিনি আরো লেখেনÑ “পনেরো আগস্টের অভ্যুত্থানকারীদের সঙ্গে এরশাদের ঘনিষ্ঠতা ও তাদের প্রতি তার সহমর্মিতা লক্ষণীয়। পরবর্তী সময়ের দুটো ঘটনা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রথমটি, খুব সম্ভবত মেজর জেনারেল জিয়ার সেনাপ্রধানের দায়িত্ব নেয়ার পরবর্তী দ্বিতীয় দিনের ঘটনা। আমি সেনাপ্রধানের অফিসে তাঁর উল্টো দিকে বসে আছি। হঠাৎ করেই রুমে ঢুকলেন সদ্য পদোন্নতিপ্রাপ্ত ডেপুটি চিফ মেজর জেনারেল এরশাদ। এরশাদের তখন প্রশিক্ষণের জন্য দিল্লিতে থাকার কথা। তাকে দেখামাত্রই সেনাপ্রধান জিয়া বেশ রূঢ়ভাবে জিজ্ঞেস করলেন, তিনি বিনা অনুমতিতে কেন দেশে ফিরে এসেছেন। জবাবে এরশাদ বললেন, তিনি দিল্লিতে অবস্থানরত তার স্ত্রীর জন্য একজন গৃহভৃত্য নিতে এসেছেন। এই জবাব শুনে জিয়া অত্যন্ত রেগে গিয়ে বললেন, আপনার মতো সিনিয়র অফিসারদের এই ধরনের লাগামছাড়া আচরণের জন্যই জুনিয়র অফিসাররা রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যা করে দেশের ক্ষমতা দখলের মতো কাজ করতে পেরেছে। জিয়া তাঁর ডেপুটি এরশাদকে পরবর্তী ফাইটেই দিল্লি ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। তাকে বঙ্গভবনে যেতেও নিষেধ করলেন। এরশাদকে বসার কোনো সুযোগ না দিয়ে জিয়া তাকে একরকম তাড়িয়েই দিলেন। পরদিন ভোরে এরশাদ তার প্রশিক্ষণস্থলে চলে গেলেন ঠিকই, কিন্তু সেনাপ্রধান জিয়ার নির্দেশ অমান্য করে রাতে তিনি বঙ্গভবনে যান। অনেক রাত পর্যন্ত তিনি সেখানে অস্থানরত অভ্যুত্থানকারীদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এর থেকেই মনে হয় এরশাদ আসলে তাদের সঙ্গে সলাপরামর্শ করার জন্যই ঢাকায় এসেছিলেন।
দ্বিতীয় ঘটনাটি আরো পরের। জিয়ার শাসনামলের শেষদিকের কথা। ঐ সময় বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের বিভিন্ন দূতাবাসে কর্মরত ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকারী অফিসাররা গোপনে মিলিত হয়ে জিয়া সরকারকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্র করে। এ পর্যায়ে ওই ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে গেলে তাদের সবাইকে ঢাকায় তলব করা হয়। সম্ভাব্য বিপদ আঁচ করতে পেরে চক্রান্তকারী অফিসাররা যার যার দূতাবাস ত্যাগ করে লন্ডনসহ বিভিন্ন জায়গায় রাজনৈতিক আশ্রয় নেয়। এ দিকে বাংলাদেশে সেনাবাহিনীতে কর্মরত কয়েকজন সদস্য একই অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে বিচারের সম্মুখীন হন। ...পরবর্তীকালে, জেনারেল এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার পর অভ্যুত্থানকারীদের মধ্যে যারা চাকরি করতে চেয়েছিলেন, এরশাদ তাদেরকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চাকরিতে পুনর্বহাল করেন। দ্বিতীয়বারের মতো পুনর্বাসিত হলো ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকারীরা। পোস্টিং নিয়ে তাদের অনেকে বিভিন্ন দূতাবাসে যোগ দেয়। শুধু পুনর্বাসনই নয়, এরশাদ আগস্ট অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত উল্লিখিত অফিসারদের কর্মস্থলে বিনানুমতিতে অনুপস্থিতকালের প্রায় তিন বছরের পুরো বেতন ও ভাতার ব্যবস্থাও করে দেন। ...প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়, অভ্যুত্থানকারীদের প্রতি কী দায়বদ্ধতা ছিল প্রেসিডেন্ট এরশাদের যে, কর্মস্থল ছেড়ে তিন বছর আইনের হাত থেকে পালিয়ে থাকার পরও ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকারীদের বিচার অনুষ্ঠান এড়িয়ে গিয়ে তাদেরকে আবার চাকরিতে পুনর্বহাল করলেন তিনি? ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রত্যক্ষভাবে উপকৃত হওয়াতেই অভ্যুত্থানকারীদের ঋণ শোধ করতে এরশাদ এ কাজ করেছিলেন কি না, এ প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। ঘটনাপ্রবাহ থেকে এ কথা মনে করা মোটেই অযৌক্তিক নয় যে, ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থান ও হত্যাকাণ্ডের পেছনে এরশাদের একটি পরোক্ষ কিন্তু জোরালো ভূমিকা ছিল।” (পৃষ্ঠা-১২০ ও ১২১)।
এ ছাড়া পরবর্তীকালেও দেখা যায়, জেনারেল এরশাদ ১৯৮৮ সালের চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফারুক-রশিদের নেতৃত্বাধীন ফ্রিডম পার্টিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দিয়েছিলেন এবং রশিদকে সংসদ সদস্যও বানিয়েছিলেন