বৃহস্পতিবার, ২৭ আগস্ট, ২০১৫

পাবনায় গণপিটুনিতে ৩ জন : গুজব রটিয়ে পরিকল্পিত হত্যা!

পাবনায় গণপিটুনিতে নিহত তিন ব্যক্তিই ছিলেন ব্যবসায়ী। অপহরণকারীর গুজব রটিয়ে একটি মহল এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে পুলিশ। তাদের নিহত হওয়ার ঘটনা নিয়ে চলছে নানা বিশ্লেষণ। কেন, কী কারণে, কারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে তা তদন্তে নেমেছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী।
গণপিটুনিতে তাদের নিহতের ঘটনায় অজ্ঞাতনামা তিন হাজার মানুষকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। নিহত আলাউদ্দিন ওরফে আলালের ভাই রানা শেখ মঙ্গলবার মধ্যরাতে মামলাটি দায়ের করেন। তবে মামলায় এখনো কাউকে আটক করতে পারেনি পুলিশ। বুধবার সকালে পাবনা জেনারেল হাসপাতাল মর্গে নিহতদের লাশ ময়না তদন্ত শেষে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
অপরদিকে গণপিটুনিতে নিহত তিনজনের নাম পরিচয় নিশ্চিত করেছে পুলিশ। নিহতরা হলেন নাটোর সদর উপজেলার লক্ষীপুর খোলাবাড়িয়া গ্রামের সুরুজ মিয়ার ছেলে সাবেক ইউপি সদস্য আলাউদ্দিন ওরফে আলাল (৫০), দিনাজপুর সদর উপজেলার নয়নপুর কোতয়ালী গ্রামের মৃত আব্দুল জলিলের ছেলে আসলাম হোসেন (৪৫) ও পাবনার আটঘরিয়া উপজেলার কড়ইতলা গ্রামের সোনাই সরদারের ছেলে বগুড়ার বিহারী কলোনীর বাসিন্দা আবু বক্কর সিদ্দিকী (৫০)। তারা পেশায় ব্যবসায়ী এবং পরস্পরের আত্মীয়।
নিহত আবু বক্কারের স্ত্রী বছিরন খাতুন বলেন, আমার স্বামী ঈদের সামনে পেঁয়াজ-রসুনের ব্যাবসা করার জন্য সাঁথিয়া চতুরহাটে গিয়েছিল। তিনি ছেলে ধরা বা অপহরণকারী ছিলেন না। এটা ষড়যন্ত্র। আমি স্বামী হত্যার বিচার চাই। নিহত আলাউদ্দিনের জামাই আইয়ুব আলী বলেন, আমার শ্বশুড়সহ নিহত তিনজন একে অপরের আত্মীয়। ব্যবসায়ীর উদ্দেশ্যে চতুরহাটে এসেছিল। পরিকল্পিতভাবে একটি চক্র অপহরণের গুজব ছড়িয়ে তাদের নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করেছে।
বুধবার সরেজমিনে গেলে স্থানীয় বাসিন্দা ও প্রত্যক্ষদর্শীরা সাংবাদিকদের জানান, মঙ্গলবার দুপুরে নগরবাড়ী থেকে ছেড়ে আসা বগুড়াগামী আলিফ পরিবহন নামে একটি বাস বগুড়া-নগরবাড়ী মহাসড়কের সাঁথিয়া উপজেলাধীন করমজা চতুরহাট নামক স্থানে পৌঁছায়। এসময় বাসে থাকা তিন ব্যক্তিকে জোর করে গাড়ি থেকে নামিয়ে প্রতিভা বিপনন কেন্দ্রের সামনে নিয়ে নিজেরাই এলোপাথারি পেটাতে থাকে এবং তাদেরকে ছেলে ধরা (অপহরণকারী) বলে চিৎকার করতে থাকে। বেশকিছু দিন ধরে সাঁথিয়া ও বেড়া উপজেলায় কয়েকটি অপহরণের ঘটনায় আতঙ্ক ও ক্ষোভ বিরাজ করছিল স্থানীয়দের মাঝে। অপহরণকারী ধরার চিৎকারে হাটের লোকজনও কোনো কিছু না জেনে-শুনে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে তিন ব্যক্তির গণপিটুনিতে অংশ নেয়। মুহূর্তের মধ্যে দুই তিন হাজার লোক সেখানে জড়ো হয়ে ওই তিনজনকে ঘিরে রাখে। নির্মম প্রহারের একপর্যায়ে ওই তিন ব্যবসায়ী ঘটনাস্থলেই মারা যান। এসময় ৪ পুলিশ সদস্য তাদের উদ্ধারের চেষ্টা করলে জনতা তাদের ধাওয়া দেয়। পরে বেড়া ও আমিনপুর থানার পুলিশ এসে প্রায় পৌনে দুই ঘন্টা পর তাদের উদ্ধার করে। কিন্তু উদ্ধারের আগেই তারা মারা যান।

প্রত্যক্ষদর্শী ঘটনাস্থল প্রতিভা বিপনন কেন্দ্রের মালিক আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ রাজন জানান, ওই সময় আমি দোকানের কর্মচারীর কাছ থেকে হিসাব বুঝে নিচ্ছিলাম। হঠাৎ তিন ব্যক্তিকে ধাওয়া করে আমার দোকানের সামনে অপহরণকারী বলে অনেক লোক বেধড়ক মারপিট করতে থাকে। এ অবস্থা দেখে আতঙ্কে দোকান বন্ধ করে চলে যাই। তার পর শুনি তারা মারা গেছে। প্রত্যক্ষদর্শী (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) এক ব্যক্তি জানান, আলিফ পরিবহন থেকে ওই তিন ব্যক্তিকে জোর করে নামিয়ে হাটের মধ্যে নিয়ে যায়। এরপর অপহরণকারী ও ছেলে ধরা বলে চিৎকার করে মারপিট করতে থাকে।
অপর একটি সূত্র জানায়, করমজা চতুরহাট জেলার অন্যতম বড় হাট। হাটটির অবস্থান সাঁথিয়া উপজেলার মধ্যে হলেও নিয়ন্ত্রণ করা হয় বেড়া পৌর প্রশাসন থেকে। সীমানা নিয়েও রয়েছে দ্বন্দ্ব ও জটিলতা। কোনো ঘটনা ঘটলে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে তাই বেড়া ও সাঁথিয়া থানা পুলিশের মধ্যে দেখা দেয় দোটানা। আর এরই ফায়দা লোটে প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা। এই হাটের গরু ব্যবসায়ীদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে মঙ্গলবার অপহরণের গুজব ছড়িয়ে এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করা হতে পারে বলে ধারণা করছে অনেকে। যা তদন্ত করলে বেরিয়ে আসবে আসল ঘটনা।
পাবনা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (গোপনীয় শাখা) ছিদ্দিকুর রহমান জানান, আমরা থাৎক্ষনিকভাবে অপহরণকারী মনে করেছিলাম। কিন্ত ২৪ ঘন্টার তদন্তে আপাতত মনে হচ্ছে এটা ছিলো একটি গুজব। ব্যবসায়িক লেনদেন সংক্রান্ত একটি চক্র পরিকল্পিতভাবে তাদের হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। নিহতদের মোবাইল সিমের কল লিস্ট পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হচ্ছে। আরো তদন্ত করলে আসল অপরাধীদের সনাক্ত করা সম্ভব হবে বলি তিনি মনে করেন।
এ বিষয়ে পাবনা পুলিশ সুপার আলমগীর কবির জানান, ছেলে ধরা বা অপহরণকারী সন্দেহে তাদের পিটিয়ে হত্যা করা হলেও এর পিছনে অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে। যা অধিকতর তদন্ত করলে বেরিয়ে আসবে। অপহরণের গুজব ছড়িয়ে তাদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে কিনা সেটাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে যারাই ঘটনার সাথে জড়িত থাক তাদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হবে।