শনিবার, ২২ আগস্ট, ২০১৫

মুশফিকুর রহিম ‘ডান হাতি লারা হতে চেয়েছিলাম’

টেস্ট, ওয়ানডেতে রানের গড় ৩২.৩১ ও ৩১.১০। তবে স্বপ্ন দেখেন ক্যারিয়ার শেষে দুই সংস্করণের ক্রিকেটেই অঙ্কগুলো ৪০-এর ওপরে রেখে যাওয়ার। গত দুই-তিন বছরের ফর্মটা ধরে রাখতে পারলে সেটা অসম্ভবও মনে করেন না। তবে মুশফিকুর রহিমের সবচেয়ে বড় সম্পদ পরিশ্রম করার মানসিকতা, নিজেকে ফাঁকি না দেওয়ার সততা। ব্যাটিংয়ে ব্রায়ান লারাকে আদর্শ মানা বাংলাদেশ দলের টেস্ট অধিনায়ক কথা বলেছেন তাঁর উইকেটকিপিং আর অধিনায়কত্ব নিয়েও—
*  বাংলাদেশ দলের সবচেয়ে পরিশ্রমী ক্রিকেটার বলা হয় আপনাকে আপনি এর সঙ্গে কতটা একমত?মুশফিকুর রহিম: পরিশ্রম অল্প-বেশি সবাই-ই করে। তবে আমি বিশ্বাস করি আমাকে যে প্রতিভা আল্লাহ দিয়েছেন, কষ্ট করেই সেটার সদ্ব্যবহার করতে হবে। আমি বসে থাকলাম, যতটুকু দরকার ঠিক ততটুকুই কাজ করলাম আর সফলতা পেয়ে গেলাম, এভাবে হবে না। অন্যরা যা কাজ করে তার চেয়ে বেশিই করতে হবে আমাকে। ছোটবেলা থেকে এটাই শিখেছি। তাতে নিজের কাছে নিজে পরিষ্কার থাকি, আমি অন্তত আমার কাজটুকু তো করলাম। নিজেকে ফাঁকি না দেওয়াটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় দর্শন।
*  পরিশ্রম করার এই মানসিকতা আপনার মধ্যে কীভাবে এল?মুশফিক: বলতে পারেন পরিবার থেকে। বিকেএসপির জীবনেরও বড় আশীর্বাদ আছে। সময়ের কাজ সময়ে করতে হবে এটা ওই সময়ই শিখেছিলাম। নিজের প্রতি সৎ থাকতে হবে। নিজের কাজগুলো ঠিকভাবে করার পর ১০ ইনিংস শূন্য রানে আউট হলেও কোনো দুঃখ থাকবে না।
*  স্লগ সুইপ অনেক বেশি খেলেন এটা কি অনুশীলন করে রপ্ত করেছেন, নাকি সহজাত?মুশফিক: অনূর্ধ্ব-১৩, অনূর্ধ্ব-১৫ ক্রিকেটে থাকতেই এই শটটা খেলতে চেষ্টা করতাম। ইদানীং ক্রিকেট অনেক বদলে যাওয়ায় বেশি খেলছি। ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি এমনকি টেস্টেও বোলারদের চাপে রাখতে বা ধারাবাহিকভাবে ভালো খেলতে বাড়তি শট থাকতে হয়। স্লগ সুইপ তেমনই একটা শট। আমি এটাকে প্রকৃতিপ্রদত্তই মনে করি। স্লগ সুইপ আমাকে শিখতে হয়নি। তবে বিকেএসপিতে প্রথম দিকে মতি স্যার বলেছিলেন, সুইপ শটগুলো একজন কিপার-ব্যাটসম্যানের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ কিপারদের রিফ্লেকশন ভালো থাকে। আর রিফ্লেকশন ভালো থাকলে সুইপ শটে অনেক সুবিধা হয়। অবশ্য স্লগ সুইপই আমার একমাত্র পছন্দের শট নয়, কাভার ড্রাইভও অনেক ভালো লাগে। এটা অনুশীলন করে রপ্ত করতে হয়েছে। ব্যাটিংয়ে আমার আদর্শ ব্রায়ান লারার কাভার ড্রাইভ দেখে এই শটটা ভালো করার প্রেরণা পেয়েছি। ক্রিকেটে একটা সুন্দর কাভার ড্রাইভের চেয়ে বড় শিল্প আর কিছু নেই।
*  আপনি নাকি লারার এতটাই ভক্ত যে একসময় তাঁর জন্মদিনে বাসায় কেকও কাটতেন?মুশফিক: (হাসি) শুধু লারার কারণে ছোটবেলায় আমরা ভাইবোনেরা ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের জন্য পাগল ছিলাম। মে মাসে ওঁর জন্মদিন, আমারও। লারার জন্মদিনে ভাইবোনেরা মিলে বাসায় কেক কেটে অনুষ্ঠান করতাম। লারার কোনো খেলা মিস করতাম না। তবে ওঁর অনেক ইনিংসই আয়নায় দেখেছি। লারা বাঁহাতি আর আমি ডানহাতি। তাঁর ডানহাতি ব্যাটিংয়ের শ্যাডোটা দেখতে চাইতাম আমি।
*  লারার মতো ব্যাটসম্যান হওয়ারও ইচ্ছা ছিল তাহলে...মুশফিক: অবশ্যই...ছোটবেলায় ডানহাতি লারা হতে চেয়েছিলাম। এমনকি বিকেএসপিতে ভর্তি হওয়ার পর ক্লাস সেভেনে থাকতেই টেকনিক খাটিয়ে চেষ্টা করেছিলাম ওঁর মতো ব্যাটিং করতে। কিন্তু কাজটা কঠিন ছিল। ভাগ্য ভালো যে স্যাররা শুরুতেই বলে দেন, ‘এটা এমন এক স্টান্স যেটা ফুটওয়ার্ক থেকে শুরু করে তোমার অনেক কিছুকেই আড়ষ্ট করে দেবে।’ পরে আমিও আর ওই চেষ্টা করিনি।
*  লারা কি জানেন আপনি তাঁর এত বড় ভক্ত?মুশফিক: (হাসি) হ্যাঁ, জানেন। সর্বশেষ বিপিএলেও এগুলো নিয়ে টুকটাক কথা হয়েছে। এর আগে ২০০৭ বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজ যাওয়ার সময় ভাইবোনেরা বারবার বলে দিয়েছিল, ‘তুই লারার সঙ্গে অবশ্যই দেখা করে আসবি। বলবি আমরা বাসায় তোমার জন্মদিন পালন করি, কেক কাটি।’ কিন্তু এত বড় তারকা...লারার রুমে একা যেতে ভয় হচ্ছিল। পরে রফিক ভাইকে (মোহাম্মদ রফিক) নিয়ে গেলাম। ওনার সঙ্গে অনেক খাতির দেখতাম লারার। লারা আমার কাছে সব শুনে অবাকই হয়েছিলেন।
*  আবার একটু স্লগ সুইপ প্রসঙ্গ শটটা অনুশীলন করে শেখেননি বললেন কিন্তু এখন তো অনুশীলনেও এ নিয়ে প্রচুর কাজ করেন...মুশফিক: যেটা আমার শক্তির জায়গা, প্রতিপক্ষ কিন্তু সেটা নিয়েই বেশি পরিকল্পনা করে। অন্যদিকে আমি চাই আমি আমার শক্তির জায়গা থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা নিতে। অনেকেই নিজের দুর্বল জায়গা নিয়ে বেশি কাজ করে, আমিও করি। তবে গুরুত্ব দিই শক্তির জায়গাগুলোকে আরও শক্তিশালী করার ওপর। দুর্বল জায়গা নিয়ে খুব বেশি অনুশীলন করে লাভ নেই, কারণ আমি ওই সব শট কম খেলি।

*আপনার উইকেটকিপিং নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই আলোচনা হচ্ছে এবং এর আগে আপনিও  ব্যাপারে অবস্থান পরিষ্কার করেছেন  বিষয়ে নতুন কোনো চিন্তা কী আছে?
মুশফিক: না, নতুন কিছু নেই। তবে আলোচনা হতেই পারে। কিপিং আমার খেলার অংশ। এটা করে আমি দুই শ করেছি আবার শূন্য রানেও আউট হয়েছি। উইকেটকিপিং আমার ব্যাটিংয়ে সাহায্য করে। উইকেটটাকে অনেক কাছ থেকে দেখতে পারি তখন। অধিনায়কত্বেও এটা কাজে লাগে। এবার যেমন ফিল্ডার হিসেবে অধিনায়কত্ব করে অনেক ব্যাপারে সন্তুষ্ট ছিলাম না। বুঝতে পারছিলাম না বিপরীত অ্যাঙ্গেল থেকে কী হচ্ছে। স্লিপে দাঁড়ালেও হতো, আঙুলের চোটের জন্য সেটা পারিনি। বলছি না যে মাঠে তিনটি কাজ করা অনেক সহজ। তবে আমি তিনটি কাজই উপভোগ করি। এই বছর হয়তো টেস্টে আমার খুব বেশি রান হয়নি। এটা যে কারও ক্ষেত্রেই হতে পারে। তিন বছর ধরে সব ফরম্যাটে যেভাবে রান করেছি, বাংলাদেশের খুব কম খেলোয়াড়ই তা পেরেছে।
*  অস্ট্রেলিয়া সিরিজে আবার উইকেটের পেছনে দাঁড়ানোর ইচ্ছা আছে?
মুশফিক: আঙুলের চোটের কারণে টেস্টে লম্বা সময় ধরে কিপিং করলে ব্যাটিংয়ে গ্রিপ করতে সমস্যা হতে পারে। সে কারণে ঠিক করেছি পুরো ফিট না হওয়া পর্যন্ত দীর্ঘ পরিসরের ক্রিকেটে কিপিং করব না। চাইলে হয়তো করতে পারব, কিন্তু দলে যেহেতু একজন বিকল্প আছে, না করাই ভালো। তবে চেষ্টা করছি যত তাড়াতাড়ি ফিট হয়ে পুরোনো অবস্থায় ফিরে যেতে। যত দিন খেলব, উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলতে চাই। এটাই আমার কাজ। সে জন্য অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্টে কিপিং না করলেও অনুশীলনে করব। অভ্যাস ধরে রাখাটা জরুরি।
*  আঙুলের চিকিৎসার জন্য তো অস্ট্রেলিয়া যাওয়ারও কথা ছিল...
মুশফিক: স্ক্যান রিপোর্ট পাঠানো হয়েছে। তবে তাঁরা যদি অস্ত্রোপচারের পরামর্শ দেনও, তারপরও আমি এখনই তা করব না। অস্ত্রোপচার করলে আমাকে কমপক্ষে তিন মাস বাইরে থাকতে হবে। ক্রিকেটের ভরা মৌসুমে সেটা চাচ্ছি না। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের পর একটা বিরতি আছে। অস্ত্রোপচার লাগলে তখন করব।
*  আপনিই বলেছিলেন, ওয়ানডের অধিনায়কত্ব হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় শুরুতে খারাপ লেগেছিল এখন কি মনে হয় এর কোনো ইতিবাচক প্রভাব আছে?
মুশফিক: দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হলে যে কারওই খারাপ লাগার কথা, আমারও লেগেছে। তবে এখন মনে হয় সিদ্ধান্তটা খুব ভালো ছিল। এটা আমাকে অনেক নির্ভার করেছে। ওয়ানডেতে আমি এখন দলকে আমার সর্বোচ্চটা দিতে পারছি।
*  কয়েক দিন আগে মুমিনুলকে করেছিলাম প্রশ্নটা আপনাকেও করি...আপনার যে উচ্চতা, ক্রিকেট খেলায় কি এর কারণে কখনো সমস্যায় পড়েছেন?
মুশফিক: (হাসি) না। বরং উচ্চতায় খাটো হলে ব্যাটিংয়ে অনেক সুবিধা পাওয়া যায়। বাউন্সার বলগুলো খেলতে আমার অনেক সুবিধা হয়। বিশেষ করে বল ছাড়াটা। লম্বা ব্যাটসম্যানদের জিজ্ঞেস করলে জানতে পারবেন, ওসব বল ছাড়তে বা খেলতে তাদের কতটা সমস্যা হয়। স্পিন বল খেলার সময় দ্রুত সামনে এগোনো বা পেছনে যাওয়া, অর্থাৎ পায়ের প্রতিক্রিয়া, একটু খাটো হওয়াতে এই জিনিসগুলো আমার খুব ভালো হয়। তবে ইঞ্চি দুই লম্বা হলে হয়তো আমি আরও কিছু ক্যাচ নিতে পারতাম। ব্যাটিংয়ের তুলনায় কিপিংয়েই উচ্চতা বেশি সমস্যার সৃষ্টি করে।
*  উচ্চতা নিয়ে কখনো প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের টিপ্পনী শুনতে হয়নি?
মুশফিক: বয়সভিত্তিক পর্যায়ে বা ‘এ’ দলে খেলার সময়ও অনেকে হাসাহাসি করত। ভাবটা এ রকম ছিল, এই যে আসছে...এখনই আউট হয়ে যাবে। তখন নিজের মধ্যে একটা জেদ কাজ করত। মজার ব্যাপার হলো আমাকে উদ্দেশ করে মাঠে যত বেশি কথা হয়, তত আমার পারফরম্যান্স ভালো হয়।
*  মুমিনুল তো আপনার চেয়েও খাটো আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাঁর আগমন নিশ্চয়ই আপনার জন্য স্বস্তিদায়ক ছিল...
মুশফিক: একবার টাটেন্ডা টাইবুকে ড্রেসিংরুমে ডেকে এনে ওর সঙ্গে নিজের উচ্চতা মাপলাম। দেখি আমি ওর চেয়েও ছোট! মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তবে মুমিনুল যেদিন জাতীয় দলে সুযোগ পেল, আমিই সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছিলাম। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এখন উচ্চতায় আমার চেয়েও আধা ইঞ্চি খাটো একজন খেলোয়াড় আছে! মনে আছে, ২০০৭ বিশ্বকাপে বারবাডোজের হোটেলে এক ফটোসাংবাদিক আয়ারল্যান্ডের র‌্যাঙ্কিন আর আমাকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে ছবি তুলেছিলেন। ও ছিল বিশ্বকাপের সবচেয়ে লম্বা ক্রিকেটার আর আমি সবচেয়ে খাটো। পরে যদিও ছবিটা কোথাও দেখিনি, কিন্তু ওই মুহূর্তটা এখনো মনে আছে।