রবিবার, ২৯ নভেম্বর, ২০১৫

দু’দিনে তিন বাংলাদেশীকে গুলী করে হত্যা : সর্বোচ্চ প্রতিশ্রুতির পরও সীমান্ত হত্যা বন্ধ হচ্ছে না


বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের যৌথ উদ্যোগে সীমান্ত হত্যা জিরো টলারেন্সে নামিয়ে আনার কথা বললেও তা সম্ভব হয়নি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দেয়া সীমান্ত হত্যা বন্ধের প্রতিশ্রুতিও বাস্তবায়ন হলো না! সর্বশেষ গত শুক্রবার সকালে লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার উত্তর গোতামারী সীমান্তের ৯০১নং মেইন পিলারে ৫/৬ নং সাব পিলারের মধ্যবর্তী স্থানে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলীতে অমুল্য কুমার চন্দ্র (৩৮) নামে এক বাংলাদেশী রাখাল নিহত হয়েছে। নিহত অমুল্য কুমার চন্দ্র হাতীবান্ধা উপজেলার গোতামারী ইউনিয়নের ভুটিয়ামঙ্গল গ্রামের মহেশ চন্দ্রের ছেলে। এর আগে, গত বৃহস্পতিবার ভোররাতে সীমান্তের প্রধান খুঁটির (মেইন পিলার) ১৩নং উপস্তম্ভের (সাবপিলার) কাছে ভারতের তারালি ও সাতক্ষীরার তলুইগাছা সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ’র গুলীতে সদর উপজেলার বাঁশদহ ইউনিয়নের পাঁচরখি গ্রামের শের আলী বিশ্বাসের ছেলে মোঃ নজরুল ইসলাম ও কলারোয়া উপজেলার কাকডাঙ্গা গ্রামের আব্দুল খালেক সরদার নিহত হয়। ভারত থেকে গরু নিয়ে বাংলাদেশে আসার চেষ্টাকালে বিএসএফ’র গুলীতে এ দু’টি হত্যাকা- ঘটেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। এছাড়া শ্রীমঙ্গলের কুলাউড়া সীমান্তে উপজেলার ডবলছড়া সীমান্তের শূন্যরেখার ভারতীয় অংশ থেকে গত বৃহস্পতিবার সকালে উদ্ধার করা হয়েছে রাধে শ্যামভর (৩৫) নামে এক চা-শ্রমিকের লাশ। তিনি কুলাউড়া উপজেলার শরীফপুর ইউনিয়নের চাতলাপুর চা-বাগানের নারায়ণ ধরের ছেলে।
এদিকে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত এ ৬ মাসে সীমান্তে নিহত হয়েছেন ২৩ জন, আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৩৫ জন এবং অপহরণের শিকার হয়েছেন ৩৯ জন আর গুম হয়েছে ৩৮ জন বাংলাদেশী।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০০ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বিএসএফ’র গুলীতে বিভিন্ন সীমান্তে এক হাজার ৩৫ জন বাংলাদেশী নিহত ও ৯১৯ জন আহত হয়েছেন। অতিরিক্ত সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকের পর গত ১৭ নবেম্বর বাংলাদেশ-ভারতের স্বরাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলের বৈঠকে ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব এমএ গণপতি তার দেশের ১২ সদস্যের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন। বন্ধুপ্রতীম দু’দেশের সম্পর্ক আরো জোরদার করতে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয় বৈঠকে। এ সময় সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনার অঙ্গীকারও করেছিলেন দু’দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। নানা উদ্যোগ ও আশ্বাস সত্ত্বেও বন্ধ হচ্ছে না সীমান্ত হত্যা। বাংলাদেশ সফরকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও ভারতীয় সীমান্তরক্ষা বাহিনী বিএসএফ যৌথ উদ্যোগে সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সমঝোতা এবং চুক্তি লঙ্ঘন করে বিএসএফ সীমান্তে নিরস্ত্র বাংলাদেশীদের গুলী করে হত্যা করছে ও অবৈধভাবে বাংলাদেশ সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশী নাগরিকদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে-এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটছে যা আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন এবং বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকিস্বরূপ। সীমান্তে হত্যা বন্ধের আশ্বাস দেয়া হয় সবসময়ই, কিন্তু সে আশ্বাস এবং প্রতিশ্রুতির পুরোটাই যেন প্রহসন! বারবার বাংলাদেশী নাগরিকের রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত। বন্ধুভাবাপন্ন দু’দেশের সীমান্তে এ রকম প্রাণহানি অস্বাভাবিক, অমানবিক। সীমান্তে হত্যাকা- নতুন কোনো ঘটনা নয়। ঘটছে ঘটবে-যেন এটাই স্বাভাবিক। কোনো কিছুই মানছে না বিএসএফ। বিধিনিষেধ, পতাকা বৈঠক বা প্রতিবাদকে তোয়াক্কা না করে সীমান্তবর্তী মানুষের ওপর হিংস্র আচরণ করছে এ বাহিনী। ফেলানীকে হত্যার পর সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলিয়ে রাখলে বিশ্বব্যাপী নিন্দা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠে। এরপর ভারতের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরম ঢাকা এসে এক বৈঠকে সীমান্তে হত্যার বিষয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে উদ্বেগ জানানো হলে, তিনি আশ্বাস দেন সীমান্তে হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনা সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হবে। বাংলাদেশের ৩০টি সীমান্তবর্তী জেলা ভারতের সাথে রয়েছে। কিন্তু ভারতীয় বিএসএফ সীমান্তে যে নির্যাতনে মানবধিকার সংগঠন হতবাক।
বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়কারী এডভোকেট মোমিনুল ইসলাম বলেন, সীমান্তে সৌহার্দ-সম্প্রীতির পাশাপাশি বিএসএফ’র বেআইনী হত্যাকা- বন্ধে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত জরুরি। উভয় দেশের শান্তি রক্ষার্থে এবং সীমান্ত অপরাধ দমন করে শান্তি প্রতিষ্ঠায় দু’রাষ্ট্রেও পারস্পরিক সৌহার্দ্যরে বিকল্প নেই।