শনিবার, ২৯ আগস্ট, ২০১৫

সৎপুত্রের সঙ্গে প্রেম- মেয়েকে খুন করলেন চ্যানেলের মালিক


ইন্দ্রানী মুকের্জিয়া। ২০০২ সালের দিকে ভারতের বিখ্যাত টিভি নেটওয়ার্ক স্টার ইন্ডিয়ায় মানবসমপদ পরামর্শক হিসেবে কাজ করছিলেন তিনি। সে সময়ই স্টার ইন্ডিয়ার প্রধান নির্বাহী পিটার মুকের্জিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক হয় তার। পরে বিয়ে করেন তারা। ইন্দ্রানী ছিলেন পিটারের দ্বিতীয় স্ত্রী। কিন্তু পিটার ছিলেন ইন্দ্রানীর তৃতীয় স্বামী। স্টার ইন্ডিয়া ত্যাগ করার পর স্বামীর সঙ্গে মিলে আরেকটি মিডিয়া নেটওয়ার্ক তৈরি করেন ইন্দ্রানী। সে মিডিয়া নেটওয়ার্কেরই অধীনে রয়েছে জনপ্রিয় বলিউড গানের চ্যানেল-নাইন এক্স 
। গত পরশু তাকে নিজ মেয়েকে খুনের অভিযোগে গ্রেপ্তার করেছে মুম্বই পুলিশ! এ ঘটনায় আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে ভারতে।
চমকে উঠার মতো তথ্য হলো, ইন্দ্রানীকে তার মেয়ে শীনা বোরাকে খুনের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হলেও এতদিন ধরে সবাই জানতেন শীনা বোরা ছিল তার ‘বোন’! চার বছর আগে প্রথম গুজব বের হয়, শীনা বোরা তার আগের ঘরের মেয়ে। কিন্তু তখনও হালে পানি পায়নি সেসব গুজব। ২০১২ সাল থেকে শীনাকে কেউ দেখেনি। তখনই তাকে খুন করা হয়। কিন্তু পরশু পর্যন্ত দুনিয়া জানতো শীনা যুক্তরাষ্ট্রে লেখাপড়া করছেন। কিন্তু সবকিছুই পাল্টে গেল একটি মাত্র ঘটনায়। ইন্দ্রানীর গাড়িচালক শ্যাম রায়কে গোপন তথ্যের ভিত্তিতে কয়েকদিন আগে একটি অস্ত্র মামলায় গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে এমন তথ্য, যা তদন্তকারীদেরও স্তব্ধ করে দেয়। শ্যাম রায় পুলিশকে জানায়, শীনা বোরা ইন্দ্রানীর বোন নয়, মেয়ে। তাকে চার বছর আগে ইন্দ্রানী নিজে শ্যামসহ কয়েকজন সহযোগীকে দিয়ে খুন করে। মৃত্যুর সময় শীনার বয়স ছিল ২৪ বছর। নিজের নানা-নানীর কাছে তিনি বড় হন। কিন্তু দুনিয়ার সবাই তখনও জানতো, এ নানা-নানী ছিল তার পিতা-মাতা! মেয়ে শীনাকে শুধু খুন করেই ক্ষান্ত হননি ইন্দ্রানী। বরং লাশ পুড়িয়ে পুঁতে ফেলেন মুম্বই শহর থেকে ৮৪ কিলোমিটার দূরে রাইগাডের গভীর জঙ্গলের এক খামারবাড়ির ভেতরে। শ্যাম রায় পুলিশকে ওই স্থানে নিয়েও যান। প্রথমে এ তথ্য বিশ্বাস করেনি পুলিশ। তবে রাইগাড পুলিশকে তথ্যটি যাচাই করতে বলে মুম্বই পুলিশ। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, শ্যামা রায়ের তথ্যের ভিত্তিতে ওই স্থানে পাওয়া যায় একটি দেহাবশেষ! এ তথ্যে চমকে উঠে মুম্বই পুলিশ। ওই দেহাবশেষ এখন ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য মুম্বইয়ে নেয়া হয়েছে। এ খবর পেয়ে খোদ মুম্বই পুলিশ প্রধান রাকেশ মারিয়া ঘণ্টার পর ঘণ্টা জেরা করেন ইন্দ্রানীকে। ইন্দ্রানী অনেকক্ষণ অস্বীকার করলেও একপর্যায়ে খুনের কথা স্বীকার করেন। সঙ্গে সঙ্গেই তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর কলকাতা থেকে ইন্দ্রানীর দ্বিতীয় স্বামী সঞ্জীব খান্নাকেও আটক করে পুলিশ।
তবে শীনাকে হত্যার উদ্দেশ্য সম্পর্কে এখনও পরিষ্কার কিছু জানানো হয়নি। প্রাথমিকভাবে পুলিশ ধারণা করছে, পারিবারিক দ্বন্দ্বের কারণেই খুন হয় শীনা। ইন্দ্রানীর বর্তমান স্বামী পিটার মুকের্জিয়ার আগের ঘরের ছেলে রাহুলের সঙ্গে প্রেম করতো শীনা। এ বিষয়টি কিছুতেই মানতে পারেননি তিনি। এটিও শীনাকে হত্যার অন্যতম কারণ হতে পারে। স্ত্রী ইন্দ্রানীর গ্রেপ্তার ও পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে স্তব্ধ হয়ে গেছেন পিটার মুকের্জিয়া। তার মনে হচ্ছে, ১৫ বছরের সংসার জীবনে তাকে পুরোটা সময় অন্ধকারে রাখা হয়েছে। তিনিও জানান, তার ছেলে রাহুলের সঙ্গে শীনার সম্পর্ক নিয়ে তীব্র আপত্তি ছিল ইন্দ্রানীর। কেননা, সম্পর্কে শীনা ও রাহুল সৎভাই-বোন। তাদের মধ্যে প্রচলিত বিধানে সম্পর্ক হতে পারে না। কিন্তু তারা যে সৎভাই-বোন, এটা কেবল জানতেন ইন্দ্রানী। আবার পিটারেরও আপত্তি ছিল। কেননা, তিনি জানতেন শীনা তার শ্যালিকা। সে হিসেবেও নিজের ছেলের সঙ্গে শ্যালিকার সম্পর্ক মানতে পারেননি তিনি। তবে নিজের আপত্তির কারণ সম্পর্কে এ বিষয়টিকে সামনে আনেননি পিটার। তিনি বলেন, শীনা রাহুলের সঙ্গে থাকছিল, যার কিনা কোন আয়ই নেই। এ সমপর্ক নিয়ে ভীষণ অসন্তুষ্ট ছিল ইন্দ্রানী। শীনার পিতা-মাতার (প্রকৃতপক্ষে ইন্দ্রানীর পিতা-মাতা) পক্ষ থেকেও প্রচুর চাপ ছিল। কিন্তু গত পরশুই পিটার জানতে পারেন, শীনা আসলে ইন্দ্রানীর বোন ছিল না। ছিল ইন্দ্রানীর মেয়ে। পিটার বলেন, আমি কখনোই গুজব সিরিয়াসলি নিইনি। চার বছর আগে প্রথম যখন এ গুজব শুনেছি, সঙ্গে সঙ্গে উড়িয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু এখন এ তথ্য নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকেই আসছে। এটি আরও বেশি ভয়াবহ বিষয়। আমি বিশ্বাস করতে শুরু করেছি, আমি চার বছর আগে যা শুনেছি, তা সত্যি হতে পারে। পিটার বলেন, ২০১২ সালে শীনা নিখোঁজ হয়। কিন্তু আমাকে বলা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে পড়ালেখার জন্য গিয়েছে সে। আমি তখন কিছুটা আশ্বস্ত হই। আমার ছেলে রাহুলকে বলি সে যাতে শীনাকে ভুলে যায় ও সামনের দিকে অগ্রসর হয়। গত পরশুর আগেও আমি জানতাম, শীনা তার পিতামাতার পরিচয় সম্পর্কে জানতো। কিন্তু আমি এখন জানলাম, ইন্দ্রানীই ছিল শীনার মা! আমি স্তব্ধ হয়ে গেছি!
শীনার নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারে তিনি কোন মামলা বা অভিযোগ দায়ের করেননি ইন্দ্রানী। বরং, শীনা যুক্তরাষ্ট্রে ভাল আছে বলে দাবি করে আসছিলেন তিনি। ওদিকে গুয়াহাটিতে থাকা শীনার ভাই মিখায়েল, যাকে ইন্দ্রানী নিজের ভাই বলে দাবি করতেন, তিনি বলেন, আমি শীনাকে বহুবার ফোন দিয়েছি। কিন্তু শীনা কখনোই ফোন ধরতো না। ইন্দ্রানী আমাকে বলতো, শীনা যুক্তরাষ্ট্রে আছে। ও ভালই আছে। প্রায় দেড় বছর ধরে এমন হয়েছে। কিন্তু আমি খোঁজ নিয়ে দেখি সে আসলে যুক্তরাষ্ট্রে নেই। এরপর আমি তাকে শীনাকে নিয়ে প্রশ্ন করা বন্ধ করে দিই। মিখায়েল বলেন, আমাকে ও আমার বোন শীনাকে কখনোই ইন্দ্রানী নিজের সন্তান বলে স্বীকৃতি বা পরিচয় দেননি। কিন্তু মিখায়েল নিশ্চিত করে জানান, তিনি ও শীনা ইন্দ্রানীর সন্তান ছিলেন। যদিও ইন্দ্রানীকে বোন বলে পরিচয় দিতে হতো তাদের। মিখায়েল বলেন- হ্যাঁ, শীনা ও ইন্দ্রানীর মধ্যে প্রচুর ঝগড়া হতো। কিন্তু কী নিয়ে ঝগড়া হতো, তা জানাতে রাজি হননি মিখায়েল। তবে তিনি জানান, আমি শুনেছি ইন্দ্রানী সব স্বীকার করেছেন। আমি চাই সে নিজেই যাতে সবকিছু খুলে বলে পুলিশের কাছে। কিন্তু সে যদি অস্বীকার করে, তবে আমি সব প্রমাণ গণমাধ্যমকে দেবো। আমার কাছে সব ছবি ও প্রমাণ আছে। তবে হত্যাকাণ্ডের মূল উদ্দেশ্য সম্পদ বা অর্থ নয় বলেই তার দাবি। তিনি বলেন, আমি শুধু বিচার চাই। শীনা নির্দোষ এক মেয়ে। সে এভাবে খুন হতে পারে না। আমার বিশ্বাস, আমি বিচার পাবো। তবে কেন ইন্দ্রানীকে এতদিন নিজের বোন বলে পরিচয় দিতেন তার কারণও ব্যাখ্যা করেছেন মিখাইল। তার দাবি, আর্থিকভাবে ইন্দ্রানীর ওপর নির্ভর করতে হতো তাদের। বিশেষ করে নানা-নানীর অসুখের খরচও চালাতে হতো। সত্যি কথা প্রকাশ করলে এসব বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দিতো ইন্দ্রানী।